টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায়

টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায় না জানলে আপনি টমেটোর ফলন ভালো পাবেন না। এইজন্য আপনাকে টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায় জানতে হবে। এই পোস্টে টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায় এর জন্য টমেটোর গাছকে বাঁচাতে কাঁটা বেগুন গাছের সাথে জোড়া কলম করে নিতে হবে। অধিক ফলন পেতে সঠিকভাবে পরিচর্যার মাধ্যমে টমেটোর এই রোগকে প্রতিকার করতে হবে। এই ব্যাকটেরিয়াজনিত সমস্যা দূর করতে জোড়া কলমের মাধ্যমে সুস্থ করে তুলতে হবে। 

পেজ সূচিপত্র

টমেটোর ঢলে পড়া রোগ কি

টমেটোর ঢলে পড়া রোগ মূলত টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায় না জানলে ব্যাকটেরিয়া জনিত সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। গাছের পরিত্যাক্ত অংশ থেকে এই জীবাণু বেঁচে থাকে, যার ফলে ধীরে ধীরে টমেটোর এই ঢলে পড়া রোগ হয়।
অর্থাৎ মাটিবাহিত কোন ছত্রাকের আক্রমণে অথবা স্যাতঁস্যাতেঁ যুক্ত জায়গায় মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া বিরাজ করলে, ধীরে ধীরে এই রোগের আক্রমণ বাড়তে থাকে। বীজ অঙ্কুরোদগমের পরেই প্রাথমিকভাবেই এই চারা মারা যেতে পারে।

ভালো করে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, চারার মাটির কাছাকাছি অংশে পৌঁছে চিকন হয়ে যায়। পরবর্তীতে কান্ডের গায়ে ছত্রাকের উপস্থিতি দেখা যায়, যার ফলে চারার গোড়া চিকন হয়ে যায় এবং লিকলিকে হয়ে ঢলে পড়ে ও মারা যায়।

টমেটোর ঢলে পড়া রোগের লক্ষণ

টমেটোর ঢলে পড়া রোগের লক্ষণ জেনে নিয়ে ভালোভাবে টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায় খুঁজে নিতে হবে। টমেটোর ঢলে পড়া রোগের লক্ষণগুলো হলো -

  • মাটিবাহিত রোগ যেমন ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট নামক একটি লক্ষণ প্রকাশ পায়।
  • এই রোগের জীবাণু গাছের শিকড় এর ক্ষত জায়গা দিয়ে ঢুকে পড়ে।
  • গাছের যে সকল পানি পরিবহন নালী রয়েছে সেখানে বংশবিস্তার করে নালিগুলো বন্ধ করে দেয়।
  • এর ফলে পাতা ও গাছ যখন সবুজ থাকে সেই অবস্থায়ই ঢলে পড়ে।
  • এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর গাছটির সবুজ থাকতেই মারা যায়।
  • এই অবস্থায় রোগাক্রান্ত গাছের কান্ড মাটি থেকে একটু উপরে ছুরি দিয়ে কেটে পরিষ্কার রাখতে হবে।
  • কেটে পরিষ্কার করার পর কাচের গ্লাসে পানিতে রাখলে দেখবেন সাদা সূঁতার মতো পুঁজ বের হচ্ছে।
  • পোস্ট ইমারজেন্স ড্যাম্পিং অফ এর সময় চারার কর্টিকেল কোষ দ্রুত কুঁচকে যায়।
  • চারা গাছ ধীরে ধীরে কালচে হয়ে যায়।
  • চারার কান্ডে মাটির কাছাকাছি পৌঁছে চিকন হয়ে যেতে থাকে।
  • কান্ডের গায়ে হঠাৎ করেই ছত্রাকের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
  • এই ধরনের লক্ষণগুলো দেখার সাথে সাথেই রোগের জীবাণুকে সহজেই সনাক্ত করা যায়।

টমেটোর ঢলে পড়া রোগের কারণ

টমেটো উৎপাদনের সময় বিভিন্ন ধরনের রোগ বালাই দেখা দেয়। এই রোগগুলোর কারণ না জানতে পারলে রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। টমেটোর ঢলে পড়া রোগের কারণগুলো হলো -

১। টমেটোর ঢলে পড়া রোগের মধ্যে পাতা কোকড়ানো এক ধরনের রোগ রয়েছে, যা ভাইরাসের আক্রমণে হয়ে থাকে। পাতা কোঁকড়ানো রোগটি সাদা মাছি নামক এক ধরনের পোকার আক্রমণে হয়ে থাকে। এই ধরনের পোকা গাছকে অসুস্থ করে দেয়।

২। কুচি পাতাগুলো ধীরে ধীরে যখন বিবর্ণ হয়ে যায়। জীবাণু যখন আক্রমণ করে ফেলে তখন খেয়াল করে দেখবেন, ঢাল কেটে পানিতে রাখলে সাদা কষের মতো তরল পদার্থ বের হচ্ছে যার ফলে পাতা ঢলে যায়।

৩। গাছ অনেক বেশি খর্বাকৃতির হয়ে যায়, পাতায় ঢেউয়ের মতো ভাব সৃষ্টি হয় এবং বয়স্ক কুকড়ানো পাতা ধীরে ধীরে মচমচে হয়ে যায়।

৪। টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায় না জানলে এই অবস্থায় আক্রমণের সাথে সাথেই পাতা মরে যায় এবং গাছের অতিরিক্ত শাখা গুলো ফুল ও ফল ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

৫। বীজ ভালোভাবে শোধন না করলে, এই ঢলে পড়া রোগ হয়। বীজকে শোধন করার পূর্বে জমির মাটি ভালো করে শোধন করে নিতে হবে। প্রয়োজনে অডুস্টিন মিস্কার নামক পানিতে দুই ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলে বীজ শোধন হয়ে যাবে।

৬। যেই জমিতে বীজ বপন করবেন সেখানে যদি কেঁচোর পরিমাণ অনেক বেশি থাকে, তাহলে এই ঢলে পড়া রোগ হতে পারে। এই অবস্থায় আপনাকে ভিটাপুরান দিতে হবে এবং কিছুদিন পরপর মাটিতে নিড়ানি দিতে হবে।

৭। রালসটোনিয়া সোলানেসিয়ারাম মুখ এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে টমেটোর ঢলে পড়া রোগ হতে পারে। কারণ পরিত্যক্ত অংশ থেকে অর্থাৎ স্যাঁতস্যাঁতে মাটি থেকে এই জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে। সেচের পানির মাধ্যমে অথবা কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে এই রোগ ছড়িয়ে যেতে পারে।

৮। উচ্চ তাপমাত্রা ও অধিক আর্দ্রতায় এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনেক জায়গায় দেখা যায়, উন্নত জাত হলেও টমেটোর পিছন দিকে কালো কালো দাগ হয়ে যায়।

৯। ক্যালসিয়ামের অভাব হলে, শুকনো মাটি বা বেশি ভেজা কোন মাটি অথবা নোনা মাটি হলে অনিয়মের কারণে এই ঢলে পড়া রোগের সৃষ্টি হয়।

টমেটোর পাতা কুঁকড়ে গেলে কি করবেন

টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায় জেনে টমেটোর পাতা কুঁকড়ে গেলে রোগে আক্রান্ত গাছ দেখামাত্রই আপনাকে তুলে ফেলতে হবে। এই রোগাক্রান্ত চারাকে আবার পুনরায় কোন অবস্থাতেই লাগানো যাবেনা। যত দ্রুত সম্ভব এই চারাগুলোকে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।

সুস্থ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে, যেন পরের মৌসুমে চারা তোলার জন্য বীজ লাগাতে পারেন। বীজকে শোধন করার জন্য কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন যা টমেটোর পাতা কুঁকড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারে। এছাড়াও টমেটোর পাতা খেয়ে ফেললে এক ধরনের কিছু পোকা রয়েছে।
সেই পোকা গুলোকে দমন করার জন্য এডমায়ার কীটনাশক এক লিটার পানিতে মিশিয়ে সাত থেকে দশ দিন পর পর ছিটিয়ে দিতে পারেন। কিছুদিনের মধ্যেই খেয়াল করলে দেখতে পাবেন টমেটোর পাতা কিছুদিনের মধ্যেই কুঁকড়ে যাওয়া থেকে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসছে।

টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায়

টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায় এর জন্য কাঁটা বেগুন গাছের সাথে জোড়া কলম করে নিতে পারেন। গাছকে বাঁচাতে এই পদ্ধতি খুবই কার্যকরী। এই পদ্ধতিতে টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকার করা সম্ভব হতে পারে যেমন,

১। আপনাকে অবশ্যই টমেটোর চারা গাছ লাগানোর পূর্বে কাঁটা বেগুনের বীজ লাগিয়ে চারা তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে।

২। এইভাবে কাটা বেগুনের বীজ যখন লাগিয়ে দিবেন, তখন মিনিমাম দশ দিন পর থেকে টমেটোর বীজ লাগিয়ে চারা তৈরি করে নিতে হবে।

৩। এইক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাকে বিশ থেকে পঁচিশ দিনের বয়সের কাঁটা বেগুনের চারা নিতে হবে এবং এর উপরের অংশ কেটে নিতে হবে।

৪। এর নিচের অংশ রেখে দিয়ে এর মধ্যে পনের দিন বয়সের ছোট টমেটোর চারা উপরের অংশে রেখে জোড়া কলম করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় অবশ্যই আপনাকে পলিথিন ক্লিপ দিয়ে বেঁধে দিতে হবে।

৫। জোড়া কলম করে ফেলার পর এই চারাটিকে অবশ্যই তিন থেকে চার দিন পর্যন্ত আপনাকে ছায়াযুক্ত কোন একটি জায়গায় রেখে দিতে হবে।

৬। এই টমেটোর চারাটি যখন সতেজ হয়ে উঠবে, ধীরে ধীরে বড় হতে থাকবে। এই অবস্থায় আপনাকে টবে বা কোন ধরনের ফিল্ডে এই চারাটিকে লাগিয়ে দিতে হবে।

৭। এছাড়াও গাছ লাগানোর পর যদি কোন রোগ আক্রান্ত গাছ দেখতে পান, তাহলে তুলে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।

৮। ঢলে পরা রোগ যেন সহনশীল করতে পারে এবং এই রকম জাতের চাষ করা উচিত যেন খুব সহজেই চারা ক্ষতিগ্রস্ত না হতে পারে।

৯। টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায় জেনে পরিমিত সেচ নিয়মিত দিতে হবে, যদি কোনো কারণে এই রোগ হয়েই যায় তাহলে সেচ বন্ধ করে দিতে হবে।

১০। প্লান্টোমাইসিন এক গ্ৰাম দশ লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে খুব ভালোভাবে স্প্রে করতে পারেন, যেন খুব সহজেই এই রোগ প্রতিরোধ করতে পারে।

১১। প্রতি হ্যাক্টরে পাঁচ টন অর্ধপচা মুরগির বিষ্ঠা লাগিয়ে কমপক্ষে একুশ দিন পর্যন্ত জমিতে দিতে পারেন এবং মাটির সাথে ভালোভাবে পচিয়ে ফেলতে পারেন।

১২। সরিষার খৈল পাঁচশ কেজি হারে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে, যা প্রতি হ্যাক্টরে প্রয়োগ করতে হবে।

১৩। ফুরাডান পাঁচ জি নামক কৃমিনাশক পঁচিশ কেজি হেক্টর হারে চারা লাগানোর সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।

টমেটোর ঢলে পড়া রোগের সমাধান

টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায় জেনে রোগকে সমাধান করতে হলে প্রাথমিক অবস্থায় আপনাকে বীজ শোধন করে নিতে হবে। এর পূর্বে জমির মাটি এমনভাবে শোধন করে নিতে হবে যেন কোন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ না থাকে। এর জন্য জমিতে বেশি পরিমাণে পটাশ ও জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।

উপকারী ছত্রাক ট্রাইকোডারমা ভিরিডি জৈব সারের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে টমেটোর ঢলে পড়া রোগের সমাধান খুব ভালো পাওয়া যায়। এই সময় নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে। দুই গ্রাম চুন প্রতি লিটারে পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
এছাড়াও আপনি বীজ শোধন করে ব্যবহার করতে পারেন। বীজের গাছ যখন মাত্র তিন মাস হয়, তখন গাছ যদি আপনার সুস্থ থাকে তাহলে গ্রাফটিং গাছ সাত মাস পর্যন্ত ফল দিতে সক্ষম হতে পারে। এই পর্যায়ে আপনাকে বাদাম, সরিষা, ভুট্টা ফসল চাষ করতে হবে।

যখনই আপনি রোগাক্রান্ত কোন গাছ দেখবেন তখন মাটিসহ তুলে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। টমেটোর জমি কখনোই  স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় রাখা যাবে না। ব্লিচিং পাউডার চাষের সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। সব সময় আপনাকে সুস্থ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে এবং সুস্থ চারা লাগাতে হবে।

রোগ আক্রান্ত গাছ থেকে কখনোই বীজ সংগ্রহ করা যাবে না। জমিতে কাজ করার সময় অবশ্যই তামাক, বিড়ি, সিগারেট ও ধূমপান এইগুলো করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়াও সাদামাছি নিধনের জন্য আপনাকে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।

শেষকথা

আশা করছি টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায় জেনে নিয়ে সঠিকভাবে টমেটোর চাষ করতে পারবেন। যদি বিস্তারিত টমেটোর ঢলে পড়া থেকে প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে তথ্য জেনে উপকৃত হয়ে থাকেন, তাহলে পোস্টের নিচের অংশে মন্তব্য করে আমাদের পাশেই থাকুন। ২৫২৭৫

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url